আব্রাহাম লিঙ্কন শুধু আমেরিকান নন, পৃথিবীর ইতিহাসের যে কয়জন মানবতাবাদী গণতন্ত্রপ্রেমী মহান রাষ্ট্রনায়ক জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি তাদের অন্যতম।
লিঙ্কনের জন্ম হয় আমেরিকার কেন্টাকি প্রদেশের একটি ছোট গ্রামে। লিঙ্কনের বাবা টমাস লিঙ্কন ছিলেন ছুতোর মিস্ত্রি। লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। অতি কষ্টে দীনদরিদ্রের মতো তিনি সংসার চালাতেন। লিঙ্কনের যখন চার বছর বয়স তার বাবা ইন্ডিয়ানা প্রদেশের অরণ্যময় অঞ্চলে গিয়ে পাকাপাকিভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাড়ির চারদিকে জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বড় বড় খুঁটি পোঁতা থাকত। কাঠের কাজ আর শিকার করেই লিঙ্কনের বাবা সংসার চালাতেন। এই কঠিন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে করতে লিঙ্কন হয়ে ওঠেন পরিশ্রমী সাহসী।
লিঙ্কনের তখন ছয় বছর বয়স। হঠাৎ তার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন সেখানে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এক গ্রাম্য ডাক্তার থাকতেন পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই সাত দিন পর মারা গেলেন লিঙ্কনের মা।
মা মারা যাওয়ার পর একটি বছর অতিক্রান্ত হলো। লিঙ্কনের বাবার পূর্বপরিচিত এক মহিলার কিছুদিন আগে স্বামী মারা গিয়েছিল। সংসারে একজন মহিলার প্রয়োজন বিবেচনা করেই তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন টমাস।
সৎ মায়ের আগ্রহে তিনি শিখেছিলেন লিখতে, পড়তে, অঙ্ক করতে। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, আমার স্কুল জীবন সর্বসাকল্যে এক বছরের বেশি নয়।
ধীরে ধীরে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলেন লিঙ্কন। দীর্ঘ দেহ, উচ্চতায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি। লম্বা হাত, বলিষ্ঠ দেহ। দেহ অনুপাতে মাথাটি ছোট, যখন হাঁটতেন শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ত।
উনিশ বছরে পা দিলেন লিঙ্কন। এই সময় নিউ অর্লিয়েন্স বন্দরে কিছু পণ্য নিয়ে যাওয়ার ভার পড়ল তার ওপর। একটি বড় নৌকা বোঝাই পণ্য নিয়ে রওনা হলেন লিঙ্কন। যথাসময়ে এসে পৌঁছালেন নিউ অর্লিয়েন্সে। এখানে এসেই লিঙ্কন প্রথম দেখলেন নিগ্রো শিশু নারী পুরুষদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। দাসপ্রথার ব্যাপকতা দেখে তিনি এতখানি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তার এক সঙ্গীকে বলেছিলেন যদি আমি কোনো দিন সুযোগ পাই এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানব।
নিউ অর্লিয়েন্সের বন্দরে পণ্য বিক্রয় করে যথেষ্ট লাভ করলেন লিঙ্কন। তার কাজে খুশি হয়ে পণ্যের মালিক তাকে নিউসালেমের গুদামে ম্যানেজার করে দিলেন। এখানে কাজের তেমন চাপ ছিল না। সমস্ত অবসরটুকু তিনি নানা বিষয়ের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন।
প্রকৃতপক্ষে এখানেই তার রাজনৈতিক কাজকর্মের সাথে পরিচয় হয়। একটি প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কেন্দ্রে কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। নিজের অজ্ঞাতসারেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। লিঙ্কনের মধুর ব্যক্তিত্ব, তার জ্ঞান, সহযোগিতামূলক আচরণ, স্পষ্টবাদিতার কারণে অল্পদিনে তিনি নিউসালেমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি পরিচিত হলেন স্থানীয় একটি সরাইখানার মালিক জেমস রুটলেজর সাথে। তিনি লিঙ্কনকে স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন।
জেমসের সাথে থাকত তার একমাত্র মেয়ে অ্যানি। সুন্দর চেহারা, মধুর ব্যবহার। জীবনে এই প্রথম কোনো নারীর সংস্পর্শে এলেন লিঙ্কন। প্রথম পরিচয়ে মুগ্ধ হলেন। কিন্তু অল্প কয়েক দিনে জানতে পারলেন, অ্যানি ম্যাকলিন নামের এক যুবকের বাগদত্তা। সাময়িক আঘাত পেলেও মনকে শক্ত করে নিলেন লিঙ্কন।
ইলিনয় প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচন শুরু হয়েছে। কয়েকজনের উৎসাহে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন লিঙ্কন। কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি নির্বাচনে পরাজিত হলেন। হাতে কোনো কাজ নেই, নির্বাচনে সাফল্য পেলেন না। বাধ্য হয়ে নিউসালেমে পিয়নের চাকরি নিলেন।
১৮৩৪ সালে আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। এবার তিনি জয়লাভ করলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাকে যেতে হলো ইলিনয়ে। পরিষদের কাজকর্মের অবসরে অখণ্ড সময়, তেমন কোনো পরিচিত মানুষজন নেই। লিঙ্কন স্থির করলেন তিনি আইন পরীক্ষা দিয়ে ওকালতি করবেন। শহরের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়াশোনা শুরু করলেন।
১৮৩৬ সালে লিঙ্কন কৃতিত্বের সাথে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওকালতি আরম্ভ করলেন। বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ থাকা সত্ত্বেও অল্প দিনেই লিঙ্কন আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেন। একটি বড় কারণ ছিল তার সততা, নির্লোভ মন। তিনি কখনো কোনো অন্যায়কে মেনে নিতেন না। যদি তিনি বুঝতে পারতেন মিথ্যা মোকদ্দমায় তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে সাথে সাথে ওকালতনামা ফিরিয়ে দিতেন।
আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেয়ে রাজনীতির প্রতিই লিঙ্কন ক্রমশ আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। ১৮৩৮-১৮৪০ সালে পরপর দুবার তিনি ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন।
এই সময় ব্যবস্থাপক সভার আরেক সভ্যের সাথে পরিচয় হলো লিঙ্কনের। তার নাম স্টিফেন ডগলাস। এই ডগলাস পরবর্তী জীবনে ছিলেন লিঙ্কনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত এক নারীকে কেন্দ্র করে। মেরি টড নামের এক সুন্দরী তরুণী তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল।
এক রাত্রে ডগলাস আর লিঙ্কন গিয়েছেন নাচের আসরে। সেই আসরে এসেছে মেরি। ডগলাস ছিলেন সুদর্শন। অপর দিকে লিঙ্কন ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত, তার মধ্যে প্রকাশ পেত এক আদিম রুক্ষতা। লিঙ্কনের সেই রুক্ষতার প্রতিই আকৃষ্ট হলেন মেরি।
কিছুদিন পর মেরিকে বিবাহের প্রস্তাব করলেন লিঙ্কন। কিন্তু মেরি ছিলেন উচ্চাকাঙক্ষী, তাছাড়া সন্দেহ, ঈর্ষাবোধও ছিল প্রবল। কোনো কিছুতেই সহজে মানিয়ে নিতে পারতেন না। বিবাহের ব্যাপারে কিছুতেই লিঙ্কনের সাথে একমত হতে পারছিলেন না।
এই সময় লিঙ্কন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুস্থ হয়ে উঠতেই মেরি বিবাহের সম্মতি দিলেন। ১৮৪২ সালের ৪ নভেম্বর তাদের বিবাহ হলো। বিয়ের পর লিঙ্কন স্থির করলেন যৌথ উদ্যোগে আইন ব্যবসা শুরু করবেন। দীর্ঘদিন আইনের ব্যবসা করা সম্ভবপর হলো না লিঙ্কনের। কারণ তার স্ত্রী মেরি স্থানীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হিসেবে লিঙ্কনের কাজকর্মকে মেনে নিতে পারছিলেন না। মেরির ইচ্ছা ছিল লিঙ্কন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুক।
রাজনীতির স্রোতে পুরোপুরি নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন লিঙ্কন। অল্পদিনের মধ্যেই ইলিনয়ের রাজনৈতিক জগতে নিজেকে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশেষে ১৮৪৭ সালে ওয়াশিংটন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ হোয়াইট হাউসের অদূরেই গড়ে উঠেছে নিগ্রো দাসদের খোঁয়াড়। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিগ্রো দাসদের এখানে নিয়ে আসা হতো তারপর দক্ষিণের বাজারে চালান করে দেয়া হতো।
দীর্ঘদিন ধরেই লিঙ্কন ছিলেন এই প্রথার বিরোধী। তিনি মনে করতেন এই প্রথা যদি অন্যায় না হয় তবে পৃথিবীতে কোনো কিছুই অন্যায় নয়। লিঙ্কন পার্লামেন্টের সভায় কলম্বিয়া প্রদেশে দাসব্যবসা বন্ধ করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করলেন। সম্মিলিত বিরোধিতায় সেই বিল অগ্রাহ্য হলো।
ব্যর্থমনোরথ লিঙ্কন ফিরে এলেন সিপ্রংফিল্ডে। আবার আইনের ব্যবসা শুরু করলেন। তিনি স্থির করেছিলেন আর রাজনীতির আঙিনায় ফিরে যাবেন না। কিন্তু নিগ্রো ক্রীতদাসদের ওপর ক্রমাগত অত্যাচার শোষণ অবিচার দেখে তিনি এতখানি বিচলিত হয়ে পড়লেন দাস ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে পুনরায় তীব্র ভাষায় সরব হয়ে উঠলেন।
১৮৫৪ সালে গড়ে উঠল নতুন রিপাবলিকান পার্টি। এই পার্টির অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি এই দলের রাজনৈতিক আদর্শের কথা এত সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলেন, সমস্ত দেশ তার বাগ্মিতায় মুগ্ধ হলো।
এর অল্পদিনের মধ্যে এক ঐতিহাসিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন লিঙ্কন। দক্ষিণের দেশগুলো দাসপ্রথার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলতে আরম্ভ করেছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ডগলাস প্রবলভাবে দাসপ্রথার সমর্থন করতে আরম্ভ করলেন। লিঙ্কন তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ করলেন।
দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য জোরাল দাবি পেশ করছিল লিঙ্কন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন একটি রাষ্ট্র কখনো দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে না। আমেরিকা অবশ্যই এক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এই সময় রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য লিঙ্কনের নাম ঘোষণা করা হলো। রিপাবলিকান পদের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেন লিঙ্কন আর তার বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে প্রার্থী হলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ডগলাস।
আমেরিকার অধিকাংশ জনগণই সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিল রাষ্ট্রের এই চরম সংকটের মুখে যিনি যোগ্য হাতে নেতৃত্ব দিতে পারবেন তিনি একমাত্র লিঙ্কন। ডগলাসকে হারিয়ে লিঙ্কন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লিঙ্কন সিপ্রংফিল্ড ছেড়ে ওয়াশিংটনের দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে স্ত্রী মেরি। তার এত দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই জয় আমৃত্যু লিঙ্কনের সমস্ত মানসিক শান্তিকে কেড়ে নিয়েছিল।
মার্চ মাসের চার তারিখে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। উপস্থিত স্বল্পসংখ্যক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন দেশ থেকে দাসপ্রথা নির্মূল করতে হবে এবং কোনো কারণেই দেশ বিভক্ত হবে না।
দাসপ্রথা সমর্থনের ব্যাপারে ইতিপূর্বে উত্তর ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মতবিরোধ ছিল। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো স্থির করল তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সাউথ ক্যারোলিনার নেতৃত্বে আলাবামা, ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, লুসিয়ানা, টেক্সাস ও জর্জিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণা করে এক পৃথক যুক্তরাষ্ট্র স্থাপন করল। এই নবঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেফারসন ডেভিসের নাম ঘোষণা করা হলো।
লিঙ্কন চেয়েছিলেন দাসপ্রথা নির্মূল হোক, কিন্তু দেশ বিভক্ত হলে কখনোই তার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। তাই নিজের সীমিত শক্তিকে সম্বল করেই দক্ষিণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। শুরু হলো আমেরিকার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।
১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি লিঙ্কন চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটল। এই ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আব্রাহাম লিঙ্কন আদেশ দিচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোতে ক্রীতদাসরূপে যারা বন্দি রয়েছে তারা এখন থেকে স্বাধীন মুক্ত।’
এই আদেশ জারি করার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যদি কোনো দিন আমার নাম ইতিহাসে স্থান পায় তাহলে আমার এই কাজটির জন্যই পাবে, এতে আমি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেছি।’
যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে দক্ষিণের সেনাপতি লির অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য উত্তরাঞ্চলের সেনাবাহিনী যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে পরাজিত হতে থাকে। লিঙ্কন দেশের সমস্ত মানুষের কাছে আহ্বান জানালেন যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৈন্যদলে নাম লেখাল চল্লিশ বছরের এক প্রাক্তন ক্যাপ্টেন, নাম গ্র্যান্ট। গ্র্যান্ট সৈনিক হিসেবে ছিলেন খুব বীর সাহসী। কিন্তু তার প্রধান দোষ ছিল অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান করতেন আর এই দোষেই তার চাকরি গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত গ্র্যান্টের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছু হটতে আরম্ভ করলেন লি। দক্ষিণের একটার পর একটা শহর তার হাতছাড়া হয়ে গেল। শেষে লি আশ্রয় নিলেন রিচমন্ড শহরে। শহরের উপকণ্ঠে তখন গ্র্যান্টের কামান গর্জন করছে। এখন শুধু অপেক্ষা লির আত্মসমর্পণের।
দেশবাসীর কাছে লিঙ্কন তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘কারোর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে সকলের প্রতি উদার মনোভাব নিয়ে…আসুন আমরা সকলে মিলে আরদ্ধ কাজগুলো শেষ করি। জাতির ক্ষত আরোগ্য করা, এই যুদ্ধের গুরুভার যিনি বহন করেছেন তাকে অথবা তার বিধবা পত্নী ও পিতৃহীন সন্তানদের পালন করা, নিজেদের মধ্যে ও সকল জাতির সঙ্গে ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি অর্জন ও পোষণের ব্যবস্থা-এই আমাদের কর্তব্য।’ অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যুদ্ধ শেষ হলো। লি আত্মসমর্পণ করলেন।
ওয়াশিংটনে ফিরে এলেন লিঙ্কন। শত শত মানুষের অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে গেলেন তিনি। জনগণের ভিড় কমতেই একে একে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এসে ভিড় করে সেখানে। এখনো কত কাজ বাকি। রাতের বেলায় থিয়েটারে যাওয়ার কথা। অনেকটা মেরির অনুরোধেই তিনি রাজি হলেন। থিয়েটার হলে পৌঁছাতেই সমস্ত দর্শক তাকে অভিনন্দন জানাল। নিজের আসনে গিয়ে বসলেন লিঙ্কন আর মেরি। দু ঘণ্টা কেটে গেছে, বক্সের দরজার সামনে যে প্রহরী ছিল তার কাছে একজন লোক এসে বলল প্রেসিডেন্টকে একটা সংবাদ দিতে হবে। রক্ষী ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিতেই আততায়ী ভেতরে ঢুকেই লিঙ্কনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালাল। চেয়ারের ওপর লুটিয়ে পড়লেন লিঙ্কন।
লিঙ্কনকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো থিয়েটার হলের সামনের একটা বাড়িতে। আঘাতের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ দেহের প্রাণসত্তার দ্বন্দ্ব চলল নয় ঘণ্টা ধরে। লিঙ্কন অচেতন, সেখানে উপস্থিত মেরি, লিঙ্কনের বড় ছেলে, তার মন্ত্রিপরিষদের সবাই। সকাল সাতটায় অজ্ঞান অবস্থায় লিঙ্কন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
মৃত্যুর সময় লিঙ্কনের বয়স হয়েছিল ছাপ্পান্ন বছর। এই জীবনের মধ্যেই তিনি যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সংগ্রাম করেছেন তাই নয়, তিনি তার কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষের মর্যাদার দিগন্তকে প্রসারিত করেছেন। তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন এক সার্বজনীন আদর্শের জন্য-জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন যা কখনো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে না।
0 comments:
Post a Comment