(৫৭০-৬৩২ খ্রি.)
যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এ ধরাপৃষ্ঠের কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না, যার পদচারণে লাখ পৃথিবী ধন্য হয়েছে; আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার
মহত্ত্ব, ধৈর্য্য, ক্ষমতা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিতাচার, আমানতদারি, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ; যিনি ছিলেন একাধারে ইয়াতিম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত; যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, মহৎ রাজনীতিবিদ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল।
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার প্রত্যুষে আরবের মক্কা নগরীতে সমভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মাতা আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের ৫ মাস পূর্বে পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আরবের তৎকালীন অভিজাত পরিবারের প্রথানুযায়ী তাঁর লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বনী সা’দ গোত্রের বিবি হালিমার ওপর। এ সময় বিবি হালিমার আরেক পুত্রসন্তান ছিল, যার দুধ পানের মুদ্দত তখনো শেষ হয়নি। বিবি হালিমা বর্ণনা করেন ‘শিশু মুহামমদ কেবলমাত্র আমার ডান স্তনের দুধ পান করত। আমি তাঁকে আমার বাম স্তনের দুধ দান করতে চাইলেও, তিনি কখনো বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না।’ আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তাঁর অপর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন।’ দুধ পানের শেষ দিবস পর্যন্ত তাঁর এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল। ইনসাফ ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়ে দিয়েছেন। মাত্র ৫ বছর তিনি ধাত্রী মা হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এরপর ফিরে আসেন মাতা আমেনার গৃহে। ৬ বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা যান এবং মদিনা থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে মাতা আমেনা ইন্তেকাল করেন। এরপর ইয়াতিম মুহাম্মদ (সা.) এর লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্রমান্বয়ে দাদা আবদুল মোত্তালিব ও চাচা আবু তালিবের ওপর। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের রহমত হিসেবে; তিনি হলেন আজন্ম ইয়াতিম এবং দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে ওঠেন সত্যবাদী, পরোপকারী এবং আমানতদারি হিসেবে।
তাঁর চরিত্র, আমানতদারি ও সত্যবাদিতার জন্যে আরবের কাফেররা তাঁকে ‘আল আমীন’ অর্থাৎ ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তৎকালীন আরবে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। ‘হরবে ফুজ্জার’-এর নৃশংসতা বিভীষিকা ও তাণ্ডবলীলা দেখে বালক মুহামমদ (সা.) দারুণভাবে ব্যথিত হন এবং ৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সে চাচা হযরত যুবায়ের (রা.) ও কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে অসহায় ও দুর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে তোলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন। বালক মুহাম্মদ (সা.) ভবিষ্যৎ জীবনে যে শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত হবেন এখানেই তার প্রমাণ মেলে।
যুবক মুহাম্মদ (সা.) এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা-চেতনা, কর্মদক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য ও বিধবা মহিলা বিবি খাদিজা বিনতে খুইয়ালিদ বিবাহের প্রস্তাব দেন। এ সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি চাচা আবু তালিবের সমমতিক্রমে বিবি খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বিবাহের পর বিবি খাদিজা তাঁর ধন-সম্পদ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাতে তুলে দেন। কিন্তু তৎকালীন আরবের কাফের, মুশরিক, ইহুদি, নাসারা ও অন্যান্য ধর্ম মতাবলম্বীদের অন্যায়, জুলুম, অবিচার, মিথ্যা ও পাপাচার দেখে হযরত মুহামমদ (সা.) এর হৃদয় দুঃখ বেদনায় ভরে যেত এবং পৃথিবীতে কীভাবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে চিন্তায় তিনি প্রায়ই মক্কার অনতিদূরে ‘হেরা’ নামক পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। বিবি খাদিজা স্বামীর মহৎ প্রতিভা ও মহান ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিশ্চিত মনে অবসর সময় ‘হেরা’ পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয় তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন এবং তাঁর ওপর সর্বপ্রথম নাজিল হয় পবিত্র কোরআনের সূরা-আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত। এরপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রয়োজন অনুসারে তাঁর ওপর পূর্ণ ৩০ পারা কোরআন শরিফ নাজিল হয়।
নবুয়্যত প্রাপ্তির পর প্রথম প্রায় ৩ বছর তিনি গোপনে স্বীয় পরিবার ও আত্মীয়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন। সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেন বিবি খাদিজা (রা.) এরপর যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং ঘোষণা করেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ তখন মক্কার কুরাইশ কাফেররা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করে। এত দিন বিশ্বনবী (সা.)। কুরাইশদের নিকট ছিলেন ‘আল আমীন’ হিসেবে পরিচিত; কিন্তু এ ঘোষণা দেয়ার পর তিনি হলেন কুরাইশ কাফেরদের ভাষায় একজন জাদুকর ও পাগল। যেহেতু কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে এবং আরববাসীদের ভাষাও ছিল আরবি, তাই তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মুহাম্মদ (সা.) যা প্রচার করছেন তা কোনো সাধারণ কথা নয়। যদি এটা মেনে নেয়া হয় তাহলে তাদের ক্ষমতার মসনদ টিকে থাকবে না।
তাই তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে বিভিন্ন ভয়, ভীতি, হুমকি, এমনকি ধনদৌলত ও আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যুবতী নারীদের দেয়ার লোভ দেখাতে শুরু করে। মুহাম্মদ (সা.) কাফিরদের শত ষড়যন্ত্র ও ভয়-ভীতির মধ্যেও ঘোষণা করলেন, ‘আমার ডান হাতে যদি সূর্য আর বাম হাতে চাঁদও দেয়া হয়, তবু আমি সত্য প্রচার থেকে বিরত থাকব না।’ কাফিরদের কোনো লোভ-লালসা বিশ্বনবী (সা.) কে ইসলাম প্রচার থেকে বিন্দুমাত্র বিরত রাখতে পারেনি। মক্কায় যারা পৌত্তোলিকতা তথা মূর্তি পূজা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কুরাইশরা তাঁদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু ইসলামের শাশ্বত বাণী যাঁরা একবার গ্রহণ করেছে তাঁদের শত নির্যাতন করেও ইসলাম থেকে পৌত্তোলিকতায় ফিরিয়ে নিতে পারেনি।
৬২০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনসঙ্গিনী বিবি খাদিজা (রা.) এবং পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। জীবনের এ সংকটময় মুহূর্তে তাঁদের হারিয়ে বিশ্বনবী (সা.) শোকে-দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বিবি খাদিজা ছিলেন বিশ্বনবীর দুঃসময়ের স্ত্রী, উপদেষ্টা এবং বিপদ আপদে সান্ত্বনাস্বরূপ। চাচা আবু তালিব ছিলেন শৈশবের অবলম্বন, যৌবনের অভিভাবক এবং পরবর্তী নবুয়্যত জীবনের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র হযরত যায়েদ বিন হারেসকে সঙ্গে নিয়ে তায়েফ গমন করলে সেখানেও তিনি তায়েফবাসীদের কর্তৃক নির্যাতিত হন। তায়েফবাসীরা প্রস্তরাঘাতে বিশ্বনবীকে জর্জরিত করে ফেলে।
অবশেষে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই (নবুয়্যতের ত্রয়োদশ বছর) ইতিমধ্যে মদিনায় ইসলামী আন্দোলনের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। মদিনা বাসীগণ মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্যপদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। এত দিন মক্কায় ইসলাম ছিল কেবল একটি ধর্মের নাম; কিন্তু মদিনায় এসে তিনি দৃঢ় ভিত্তির ওপর ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি সেখানে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দেন। সে সময় মদিনায় পৌত্তোলিক ও ইহুদিরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। মুহাম্মদ (সা.) মনে-প্রাণে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের বাস সেখানে সকল সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই তিনি সেখানে সকল সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি আন্তর্জাতিক সনদপত্রও স্বাক্ষরিত হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান। উক্ত সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়।
মুহাম্মদ (সা.) হন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সভাপতি। তিনি যে একজন দূরদর্শী ও সফল রাজনীতিবিদ এখানেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মদিনার সনদ নাগরিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থাপিত হয় ঐক্য। বিশ্বনবী (সা.) তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেননি বরং উদারতার মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর ও নবদীক্ষিত মুসলমানগণের (সাহাবায়ে কেরাম) চালচলন, কথাবার্তা, সততা ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে যখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল তখন কুরাইশ নেতাদের মনে হিংসা ও শত্রুতার উদ্রেক হয়। অপরদিকে মদিনার কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাধান্য সহ্য করতে না পেরে গোপনভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কাফিরদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্যই মুহাম্মদ (সা.) তলোয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে ঐতিহাসিক বদর, উহুদ ও খন্দকসহ অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এসব যুদ্ধের প্রায় সবগুলোতেই মুসলমানগণ জয়লাভ করেন। বিশ্বনবী (সা.) মোট ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরিতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মুহাম্মদ (সা.) মাতৃভূমি দর্শন ও পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। সন্ধির শর্তাবলির মধ্যে এ কথাগুলোও উল্লেখ ছিল যে-(১) মুসলমানগণ এ বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে (২) আগামী বছর হজে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না (৩) যদি কোনো কাফির স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদিনায় গমন করে তাহলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে মদিনা হতে যদি কোনো ব্যক্তি পলায়নপূর্বক মক্কায় চলে আসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না (৪) প্রথম থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায় বসবাস করছে তাদের কাউকে সাথে করে মদিনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। (৫) আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোর এ স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমান ও কাফির) মাঝে যাদের সঙ্গে ইচ্ছা সংযোগ স্থাপন করতে পারবে (৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে। এছাড়া কুরাইশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন আমর সন্ধিপত্র থেকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দুটি কেটে দেয়ার জন্য দাবি করেছিল। কিন্তু সন্ধিপত্রের লেখক হযরত আলী (রা.) তা মেনে নিতে রাজি হলেন না।
অবশেষে বিশ্বনবী (সা.) সুহায়েল বিন আমরের আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দুটি নিজ হাতে কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহায়েল বিন আমরের দাবি অনুযায়ী ‘বিছমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখতে নির্দেশ দেন। সুতরাং বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ সন্ধি মুসলমানদের জন্য অপমানজনক হলেও তা মুহাম্মদ (সা.) কে অনেক সুযোগ ও সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল। এ সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকার করে নেয়। সন্ধির শর্তানুযায়ী অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে অমুসলিমগণ ইসলামের মহৎ বাণী উপলব্ধি করতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এ সন্ধির পরই মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ (সা.) যেখানে মাত্র ১৪০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে হুদায়বিয়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র ২ বছর অর্থাৎ অষ্টম হিজরিতে ১০,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন। যে মক্কা থেকে বিশ্বনবী (সা.) নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত হয়েছিলেন, সেখানে আজ তিনি বিজয়ের বেশে উপস্থিত হলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত ওরম ফারুক (রা.) কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে গ্রেফতার করে মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্মুখে উপস্থিত করেন। কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার এ মহান আদর্শ পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল। মক্কায় আজ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীয়মান। সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত।
৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক দশ হিজরিতে মুহাম্মদ (সা.) লক্ষাধিক মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিদায় হজ সম্পাদন করেন এবং হজ শেষে আরাফাতের বিশাল ময়দানে প্রায় ১,১৪,০০০ সাহাবির সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত। বিদায় হজের ভাষণে বিশ্বনবী (সা.) মানবাধিকার সম্পর্কিত যে সনদপত্র ঘোষণা করেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা আজও অতুলনীয়। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন (১) হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজিকার এ দিন, এ মাস এবং এ পবিত্র নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তেমনি পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ, রক্ত এবং তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের পরস্পরের নিকট। কখনো অন্যের ওপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না (২) মনে রেখ, স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে (৩) সাবধান, শ্রমিকের মাথার ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দেবে (৪) মনে রেখে যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না (৫) চাকর-চাকরানিদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ো না। তোমরা যা খাবে, তাদের তাই খেতে দেবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদের তাই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দেবে। (৬) কোনো অবস্থাতেই ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। এমনিভাবে মানবাধিকার সম্পর্কিত বহু বাণী তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে পেশ করে যান। তিনি হলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মানবজাতির একমাত্র আদর্শ এবং বিশ্ব জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরিত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নবুয়্যতের ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার সাধন করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দিয়ে, তিনি ঘোষণা করেন, ‘অনারবের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবদের; কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো পার্থক্য নেই। বরং তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে অধিক মুত্তাকিন।’ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সুদকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জাকাতভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে এমন একটি অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তাদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করেছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর কোনো মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। বিশ্বনবী (সা.) নারী জাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং ঘোষণা করলেন ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ নারী জাতিকে শুধুমাত্র মাতৃত্বের মর্যাদাই দেননি, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারকে করেছেন সমুন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। ক্রীতদাস আযাদ করাকে তিনি উত্তম ইবাদত বলে ঘোষণা করেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেখানে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা এবং বিভিন্ন বস্তুর পূজা আরববাসীদের জীবনকে কলুষিত করেছিল সেখানে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন। মোদ্দা কথা তিনি এমন একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোনো হানাহানি, রাহাজানি, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ ইত্যাদি ছিল না।
অবশেষে এ মহামানব ১২ রবিউল আওয়াল, ১১ হিজরি মোতাবেক ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল। পৃথিবীর বুকে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) গোটা মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ করে বলে গিয়েছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যত দিন তোমরা এ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে রাখবে তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন আর অপরটি হলো আমার সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস।’ বিশ্বনবী (সা.) এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, ‘He was the mater mind not only of his own age but of all ages’ অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।
শুধুমাত্র ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুরই নন, পৃথিবীর বুকে যত মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান বাণী পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা-আহযাব, আয়াত-২১)।
বর্তমানে অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্বমুখর আধুনিক বিশ্বে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকে অনুসরণ করা হলে বিশ্বে শান্তি ও একটি অপরাধমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে সম্ভব।
0 comments:
Post a Comment